সবুজে ঘেরা প্রকৃতির ছায়া বোটানিক্যাল গার্ডেন

সবুজের মেলায় প্রাণবন্ত, প্রকৃতির নির্মল ছোঁয়া, মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য আর চারপাশে দেশি-বিদেশী গাছগাছালির মিলনমেলা- বলছি বাংলাদেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান, উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রদর্শনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের কথা। রাজধানী ঢাকার মিরপুরের উত্তরে বেড়িবাঁধের সন্নিকটে জাতীয় চিড়িয়াখানার পাশেই এর অবস্থান। দর্শনার্থীদের কাছে এটি বোটানিক্যাল গার্ডেন কিংবা বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম নামেও পরিচিত। নৈসর্গিক মায়ায় মুগ্ধ হতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন অসংখ্য দর্শনার্থী। নগর সভ্যতায় হাঁপিয়ে ওঠা প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে যেন মরুভূমির মাঝে এক পানির কূপের সন্ধান!
ইতিহাসের প্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেন বা উদ্ভিদ উদ্যান প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বখ্যাত গ্রিক বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও প্রাণিবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল, খ্রিস্টপূর্ব ৩৪০ অব্দে। ইতালিতে প্রথম সর্বব্যাপী উদ্ভিদ উদ্যান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫৪৩ সালে। এরপর থেকেই ইউরোপের প্রতিটি শহরে এই ধরনের উদ্যান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। লন্ডনের শহর কিউতে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্ভিদ উদ্যান রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠা করেন উইলিয়াম জ্যাকসন হুকার, ১৭৫৯ সালে। তবে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ৮২ বছর পর, ১৮৪১ সালে। কিন্তু পরে এটি পূর্ণ উদ্ভিদ উদ্যান হয়ে ওঠে জ্যাকসন হুকারের পুত্র, বিশ্বখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ডাল্টন হুকারের হাত ধরে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল রবার্ট কিডের উদ্যোগে ১৮৮৭ সালে কলকাতার হুগলি নদীর তীরে শিবপুর পাড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ২৭৩ একর আয়তনবিশিষ্ট রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনস। শুরু হয় যদিও সেগুন গাছের চাষ দিয়ে, তবে কিডের মৃত্যুর পূর্বে এই উদ্যানে ৩০০ জাতের বিভিন্ন গাছপালা লাগানো হয়। এই নিমিত্তে জর্জ কিং, উইলিয়াম রক্সবার্গ, ডেভিড প্রেইনসহ প্রমুখ বিজ্ঞানীর প্রয়াসে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্ভিদ উদ্যান হয়ে ওঠে এটি।

১৯৬১ সালে ঢাকার অদূরে মিরপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান। ২০৮ একর আয়তনের এই উদ্যানে রয়েছে ৫৭টি সেকশন। ১১৭টি গোত্রভুক্ত ও ৫০ হাজার প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, দেশি-বিদেশী গাছপালার সমন্বয়ে গঠিত এই উদ্যান। তারই মধ্যে রয়েছে ২৫৫ প্রজাতির ২৮,২০০টি বৃক্ষ, ৩৮৫ প্রজাতির ১০,৪০০টি বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ, ৩১০ প্রজাতির ৮,৪০০টি গুল্ম, ৬৬৫ প্রজাতির বিদেশী উদ্ভিদ ও ২২ প্রজাতির একটি বিশাল বাঁশবাগান। এছাড়াও আছে নেটঘর, উষ্ণগৃহ বা গ্রিনহাউজ, যেখানে রয়েছে প্রায় ১০০ প্রজাতির ছায়াতরু, দেশি-বিদেশী ৮৫ প্রজাতির অর্কিড এবং ফিসহুক, ক্ষেপালিয়াসহ ৮৬ প্রজাতির সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি ক্যাকটাস। গ্রিনহাউজে থাকা ক্যাকটাসগুলোর সিংহভাগই মেক্সিকো থেকে আমদানিকৃত।

বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বনবিভাগ কর্তৃক পরিচালিত সবুজে ঘেরা এই উদ্যানে শিক্ষা, গবেষণা ও প্রদর্শনের জন্য প্রতিবছর প্রায় ১৫ লক্ষ দর্শনার্থী ছুটে আসেন। সুবিশাল আয়তনের এই উদ্যানে রয়েছে মোট ৭টি জলাশয়, ১টি কৃত্রিম জলপ্রপাত, ১টি দ্বীপসহ কৃত্রিম হৃদ, ১টি শাপলা পুকুর, ৩টি পদ্ম ও শাপলা ট্যাংক, ২টি আমাজন লিলি ট্যাংক, ৩টি শোভাবর্ধন বাগান, ২টি মৌসুমী ফুলের বাগান, ১টি মসজিদ, ২টি ওয়াচ টাওয়ার, ৮টি গণশৌচাগার, ৩টি স্ন্যাক্স কর্নার, এবং ১টি গ্রন্থাগার। এছাড়াও রয়েছে প্রজাপতির প্রজনন কেন্দ্ররূপে পরিচিত গোলাকৃতির পদ্মপুকুর। উদ্যানে পরিশ্রান্ত দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে ক্যামেলিয়া ও পদ্ম নীড় নামে বিশ্রামাগার।
এই উদ্ভিদ উদ্যানে আন্তর্জাতিক উদ্যান নামে ১৯৭৩ সালে গবেষণা ও দর্শনের জন্য একটি বিভাগ চালু করা হয়। যেখানে মালেশিয়ার ওয়েল পাম, অস্ট্রেলিয়ার সিলভার ওক, জাপানের কর্পুর, থাইল্যান্ডের রামবুতামসহ বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই ভিনদেশি প্রজাতির উদ্ভিদগুলো বাংলার মাটিতে খাপ খাইয়ে প্রতিনিয়তই তারা বংশ বিস্তার লাভ করছে।

সবুজে ঘেরা প্রকৃতির ছায়ার এই উদ্যান ১৯৮০-৮১ সালে দেবদারু ও ইউক্যালিপটাস বাগান তৈরি করা হয়। মেরি-গোল্ড, সালভিয়া, মর্নিং গ্লোরিসহ প্রায় ৫২ প্রজাতির ভিনদেশি মৌসুমি ফুলের বাগান, জারুল বাগান, পাম বাগান, মৌসুমি ফলের বাগান, গজারি বনসহ ছোট-বড় একাধিক বন রয়েছে এই উদ্যানে। এছাড়াও রয়েছে ভেষজ উদ্ভিদের বাগান, যেখানে তুলসী, ঘৃতকুমারী, থানকুনি, আদা, তেলাকুচা, বাসকসহ বিভিন্ন ধরনের ঔষধি উদ্ভিদের দেখা মিলবে।
এই উদ্ভিদ উদ্যানে শুধু সবুজ গাছগাছালি রয়েছে এমনটা নয়, বিচিত্র বর্ণের দেশি-বিদেশী পাখপাখালির অভয়াশ্রমও এই উদ্যান। উদ্যানের অভ্যান্তরে কোথাও মাটির রাস্তা, কোথাও ইট কিংবা পিচঢালা পথ, কোথাও সরু রাস্তা আবার কোথাও হালকা আঁকাবাঁকা পথ; পাহাড়ি পথের অভিন্নতায় উঁচু টিলা আর সবুজে ঘেরা লেকের পাশে বসে চায়ে চুমুক, হাঁটা কিংবা প্রিয়জনের সাথে গল্পে নিমজ্জিত প্রকৃতির প্রতি এক অন্যরকম অনুভূতি জাগ্রত হতে পারে আপনার মাঝে। এছাড়াও ভ্রমণকে আরো আনন্দময় করার জন্য রয়েছে লেকে কিছু অর্থের বিনিময়ে নৌযানে ভ্রমণের সুযোগ।

১৯৮০ সালে উদ্যানের প্রায় ৩.৫ একর জায়গাজুড়ে তৈরি করা হয় দুটি পৃথক গোলাপ ফুলের বাগান, যেখানে রয়েছে মিনিয়েচার ফ্লোরইয়ান্ডা, ডাবল ডিলাইট, পুলিয়েন্থাসহ প্রায় ২০০ প্রজাতির গোলাপ। তাছাড়াও প্রায় ৫ একর জায়গার উপর নির্মাণ করা হয়েছে সুবিশাল নান্দনিক নার্সারি। ফুল, ফল, লতা, ভেষজসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদের চারা রোপিত ও অভিযোজিত হয়েছে এখানে। শখের বশে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে আপনিও হতে পারেন এখানকার চারার অংশীদার।

দর্শনের সময়সূচি
কাল ও মাসভেদে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান পরিদর্শনের সময়সূচি পরিবর্তিত হয়। মার্চ-নভেম্বর মাস সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এবং ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাস সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪:৩০ পর্যন্ত উদ্ভিদ উদ্যান খোলা থাকে।
কীভাবে যাবেন
বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাওয়ার জন্য একাধিক পথ রয়েছে। নিচের যেকোনো একটি অনুসরণ করে যাওয়া যাবে সেখানে।
প্রথমত, ঢাকার আব্দুল্লাহপুর থেকে বসুমতি পরিবহন, প্রজাপতি পরিবহন, কনক পরিবহন যেকোনো একটিতে চেপে ভাড়া জনপ্রতি ৩০-৪০ টাকার বিনিময়ে চলে যান মিরপুর ১ নাম্বারে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কিংবা কিছু টাকার বিনিময়ে রিকশায় চড়ে চলে যান বোটানিক্যাল গার্ডেনে।
দ্বিতীয়ত, ঢাকার সদরঘাট থেকে মিরপুর ইউনাইটেড সার্ভিস, তাঞ্জিল পরিবহনসহ বেশ কিছু পরিবহন মিরপুর ১/বোটানিক্যাল গার্ডেনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ২৫-৩০ টাকা।
তৃতীয়ত, ঢাকার গুলিস্তান থেকে বিকল্প সার্ভিস, তাঞ্জিল পরিবহন ও কমলাপুর থেকে স্বকল্প পরিবহনসহ কিছু সংখ্যক বাস মিরপুর ১/বোটানিক্যাল গার্ডেন হয়ে যাওয়া-আসা করে। ভাড়া জনপ্রতি ২০-৩০ টাকা।
চতুর্থত, ঢাকার গাবতলী থেকে ১০-১৫ টাকার বিনিময়ে লেগুনা কিংবা টমটমে চড়েও যাওয়া যাবে।
খাবেন কোথায়
বোটানিক্যাল গার্ডেনের অভ্যন্তরে বেশ কিছু খাবারের ফেরিওয়ালা কিংবা টঙের দোকান রয়েছে। সেখানের সিংহভাগ খাবারই শুকনো বা হালকা। লাঞ্চ বা ভারি খাবারের জন্য গার্ডেনের বাইরে কিংবা মিরপুর ১ চত্বরে বেশ কিছু হোটেল বা রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সেখানে যেকোনো একটায় খাবার সেরে নিতে পারেন। উল্লেখ্য, খাবার অর্ডার করার পূর্বে দাম সম্পর্কে জেনে নেওয়া উত্তম।
সতর্কতা
১. গার্ডেনের অভ্যন্তরে ধূমপান থেকে বিরত থাকুন।
২. অবৈধ বস্তু নিয়ে গার্ডেনে প্রবেশ থেকে বিরত থাকুন।
৩. গার্ডেনের ভেতর শালীনতা বজায় রাখুন, এবং অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকুন।
This article is in Bangla. It is about the Botanical Garden, one of the most scenic places in Bangladesh, the largest center for plant species conservation, research and exhibition, located in the capital Dhaka.
References:
3. জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান – মিরপুর, বাংলাদেশ
4. ঘুরে আসুন, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান (২০০৯)
Featured Image: Wikimedia Commons